বিদেশি বিনিয়োগে খরা

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)। যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যতটা শক্তিশালী সে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ তত বেশি। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ভারত ও জাপানের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো। বাংলাদেশে করোনা মহামারি-পরবর্তী শুরু হওয়া ডলার সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এ সংকট এখনো চলছে। এর যতগুলো কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কাক্সিক্ষত হারে বিদেশি বিনিয়োগ না আসা। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, অবকাঠামো, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের তুলনায়। সর্বশেষ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধেই দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ শতাংশ। দেশি বিনিয়োগের পালেও হাওয়া মিলছে না। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিন বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত ভঙ্গুর। এখানে সব সময়ই কমবেশি অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত হারে আসছে না। সর্বশেষ প্রকাশিত ইউএনসিটিএডির ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩-এর তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসেবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের দিক থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। এর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশও। মালদ্বীপ ছোট্ট রাষ্ট্র হলেও পর্যটনের বিকাশ ও পর্যটক আকর্ষণে দেশটি শীর্ষস্থানীয়। যার ফলে দেশটি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে এগিয়ে রয়েছে। একই রকম পরিবেশ শ্রীলঙ্কারও। এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, এফডিআই আকর্ষণে বাংলাদেশে অনেকগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর অবকাঠামো, যোগাযোগ, গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এখনো নিরবচ্ছিন্ন নয়। এর সঙ্গে আছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পান না। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার-সংকটে বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কমে গেছে বিদেশি বিনিয়োগ এবং ঋণের ছাড়। এমন পরিস্থিতিতে গত দেড় বছরে দেশে বিদেশি মুদ্রার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে ডলার আয় বাড়াতে বিদেশি মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক রপ্তানি বাড়ানোয় গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এই গুরুত্বপূর্ণ খাতেই বিদেশিদের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এদিকে ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩-এর তথ্যমতে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক গড় এফডিআই এসেছে ২৯২ কোটি ডলার, যা অন্তত ৩৫০ কোটি ডলার হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট এফডিআই অস্বাভাবিক হারে কমেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নিট এফডিআই এসেছে ৬৭০ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের একই সময়ে এসেছিল ১ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আঙ্কটাডের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০১৪ সালে এফডিআইয়ের প্রবাহ ছিল ২৫৬ কোটি ডলার, ২০১৫ সালে ২২৩ কোটি, ২০১৬ সালে ২৩৩ কোটি, ২০১৭ সালে ২১৫ কোটি, ২০১৮ সালে ৩৬১ কোটি, ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি, ২০২০ সালে ২৫৬ কোটি, ২০২১ সালে ২৮৯ কোটি ডলার। আবার ২০২২ সালে রেকর্ড ৩৪৮ কোটি ডলার এলেও ২০২৩-এ এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। এফডিআইর এই ধারা বাড়াতে হলে সবার আগে বিদেশিদের পুঁজি ও লাভের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এরপর অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এই জায়গাগুলোয় বাংলাদেশের মতো দেশগুলো তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি রয়েছে। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা খুব কঠিন বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আনু মুহম্মাদ। এরপরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তা করছে। কিন্তু আমরা পারছি না। কারণ আমাদের এখানে মৌলিক জায়গাগুলোও ঠিক নেই বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে এফডিআই এসেছে ৩৪৪ কোটি ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ৩২৫ কোটি ডলার। ফলে এক অর্থবছরে এফডিআই কমেছে ৫.৫২ শতাংশ। অন্যদিকে ডিসেম্বরের শেষদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মোট এফডিআইয়ের মধ্যে মাত্র ৮০ কোটি ডলার এসেছে বিদেশ থেকে পুঁজি হিসেবে। বাকি অর্থ এসেছে দেশে কার্যরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ এবং এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগ এসেছিল ৬২ কোটি ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ২৬ কোটি ডলার।

0 Comments

Your Comment